নবিজির অবমাননা ও বাকস্বাধীনতার সীমারেখা: মুসলিমদের করণীয়
﷽
প্রশ্নটি নাইজেরীয় ভাইদের কাছ থেকে আসছে। ভাইয়েরা বলছেন, “একজন খ্রিস্টান মহিলা নবিজির - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - অবমাননা করেছে। তাই কিছু লোক তাকে হত্যা করে এবং পুড়িয়ে ফেলে। এবং তারা ঘটনাটির ভিডিয়ো করে। প্রশ্ন হলো, এই কাজটি কি জায়েয? সেসব লোকেদের প্রতি আপনার কী উপদেশ?” [১]
জবাব হলো - আর হিদায়াহ আল্লাহর পক্ষ থেকে:
১. উম্মাহর ইজমা অনুসারে নবিজির অবমাননা করা - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - চরম শয়তানিমূলক কাজ এবং আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস (কুফর)। এটা এমন এক বিষয় যা মুমিনের অন্তরকে ব্যথিত করে এবং এ বিষয়ে মুসলিমদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
২. এই কাজটির মোকাবিলা যেভাবে হয়েছে, অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে না গিয়ে অবমাননা করা ঐ মহিলাকে যে লোকেরা মেরে পুড়িয়ে ফেলেছে - তা খুবই ত্রুটিপূর্ণ যেটাতে কিছু লোক তাদের ইলমবিহীন আবেগের কারণে পতিত হয়েছে। তাই, এ কাজটি জায়েয নয়, তা এমন একটি কাজ যা বিভিন্ন দিক থেকে অসংগত:
- প্রথম হলো, শরয়ি হদ (শাস্তি) বাস্তবায়ন করা কোনো ব্যক্তির কাজ নয়, এটি যে কারো জন্য নয়। এটি কর্তৃপক্ষের কাজ এবং তা ইজমার ভিত্তিতে সিদ্ধ। [২]
- দ্বিতীয়ত, শরয়ি হদ তখনই বাস্তবায়িত হয় যখন দায়িত্বপ্রাপ্তরা নবির - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - অপমান করা ঐ ব্যক্তির গর্দান কেটে ফেলে, অতঃপর মৃত ব্যক্তিকে কবরে দাফন করে। এটাই শরিয়াহর হুকুম এবং মৃত ব্যক্তিকে পুড়িয়ে ফেলা শরিয়াহর অন্তর্ভুক্ত নয়।
লোকেরা খ্রিস্টান মহিলাটিকে মেরে তার মরদেহকে পুড়িয়ে ফেলার যে কাজটি করেছে তাতে বহু খারাবি রয়েছে:
- প্রথমত, তা নবি - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর পন্থার বিপরীত।
- দ্বিতীয়ত, সেটা আহলুস সুন্নাহর বিরুদ্ধে সরকারকে ক্ষেপিয়ে তুলবে, ফলে তারা তাঁদের বিরোধিতা করবে এবং তাদের ওপর কঠোর হবে।
- তৃতীয়ত, তা বৈদেশিক জাতিগোষ্ঠীর জন্য মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টির দরজা খুলে দিবে।
- চতুর্থত, শত্রুদের কাছে তা মুসলিমদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করবে, বরং, হতে পারে যারা ইসলাম কবুল করতে চায় তাদেরকে তা দূরে সরিয়ে দিবে।
৩. এই অবস্থায় অপরিহার্য হলো, নবির - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - অবমাননা করা ব্যক্তির বিষয়টি সরকারি কর্তৃপক্ষকে জানানো এবং সরকারই নবির - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - অবমাননায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডেকে আনবে - অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করবে এবং তার ওপর শরয়ি হদ বাস্তবায়নের শর্ত ও বাধাসমূহ যাচাই করবে। এরপর, যদি শর্ত পাওয়া যায় এবং কোনো বাধা অনুপস্থিত থাকে, তারা শরয়ি হদ কায়েম করবে।
৪. নবির - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - অপমান নিষিদ্ধকরণ এবং অবমাননা করা ব্যক্তির ওপর শরয়ি হদ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে নিবেদন জানানো মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত।
৫. সরকার কিছুই করবে না এমনটা যদি জানা থাকে, তাহলে সবর করা এবং হিকমাহ ও কল্যাণময় সতর্কবাণীর মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ডাকা দরকার। নিশ্চয়ই, মক্কার কুরাইশরা প্রায়ই নবি - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অপমান করে বেড়াত এবং তাঁকে জাদু, কবিতা, ভোজবাজি ইত্যাদির মতো বিষয়ে বর্ণনা করতো। তারা বিভিন্ন উপায়ে তাঁর ক্ষতি করতো, তাঁর ওপর উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিতো। তো, তারা তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে তাঁর - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - ক্ষতি করতো। আর নবি - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - থেকে তা দূরীভূত করার সেই সক্ষমতা মুমিনদের ছিল না, আর তাঁদেরকে আল্লাহ কোনোকিছুর জন্যই দায়ী করেননি এবং তাঁদের দুর্বলতার কারণে তাঁদের কাউকে দোষারোপ করেননি। বরং, নবি - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - সবর করা, এড়িয়ে যাওয়া এবং ক্ষমা করে দেওয়ার নির্দেশ পান। আর অবশ্যই, আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিস্টান) ও পৌত্তলিকদের মাধ্যমে অপমানিত হলে তাতে ধৈর্য ধরার আদেশ সম্পর্কিত বহু আয়াত বিদ্যমান। এভাবে, (উলামাদের) কেউ কেউ বলেছেন, “জিহাদ, জিযিয়া সংগ্রহ এবং এরকম বিষয় সম্পর্কিত আয়াতের মাধ্যমে তা রহিত (মানসুখ) হয়ে গেছে”, এবং অন্যান্যরা বলেছেন, “তা দুর্বল অবস্থায় প্রয়োগযোগ্য।”
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (رحمه الله) “সারিমুল মাসলুল” গ্রন্থে বলেছেন:
“এমন অনেকেই রয়েছেন যারা বলেন যে, জিহাদে মুসলিমদের দুর্বলতার কারণে প্রয়োজনীয়তার স্বার্থে ক্ষমা করা যায়, যখন তারা এমন এক সময় ও স্থানে থাকে যেখানে তারা তা করতে অপারগ। তো, তা মানসুখ নয়, কারণ মানসুখ হওয়ার মানে হলো তা সকল ভবিষ্যত সময়ের জন্য উত্থিত হয়ে গেছে।” [৩]
ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাহবিহি আজমায়িন।
- শাইখ আলি আল-হুজাইফি (حفظه الله)
বিশিষ্ট সালাফি আলিম, মাসজিদ আন-নাবাওয়ির সম্মানিত ইমাম ও খতিব, ১২ই শাওয়াল ১৪৪৩হি
ফুটনোট:
[২] লাজনাহ আদ-দায়িমাহর ফাতাওয়া (২২শ খণ্ড, পৃ. ৫)
[৩] আস-সারিমুল মাসলুল আলা শাতিম আর-রাসুল, ১ম খণ্ড, ২৩৯ পৃ.