রামাদানে রুহের সুরক্ষা এবং এ মাসে ক্ষতিগ্রস্তদের স্তর: শাইখ আল-ফাওযানের উপদেশ

সালাফি দাওয়াহ বাংলা



 মাসকে কাজে লাগান, আল্লাহ আপনাদের প্রতি রহম করুন, কারণ আপনাদের অনেকের জন্য এটি আর ফিরে আসবে না। তাই আল্লাহ (আযযা ওয়া জাল) আপনাদের যে সামর্থ্য দিয়েছেন এবং তিনি যে আনুগত্যমূলক কাজ ও উৎসাহিত করার মাধ্যম সহজ করে দিয়েছেন, তার দ্বারা এই সুযোগটি গ্রহণ করুন। এ মাসের মর্যাদা বুঝুন এবং আল্লাহর, জাল্লা ওয়া আলা, আনুগত্যের মাধ্যমে এই মাসের যথাযথ হক আদায় করুন। বেশি বেশি দোয়া করুন, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং তাঁর কাছে তওবাহ করুন, কারণ এই মাসের আগমন মুসলমানদের জন্য কল্যাণকর। যদি একজন মুসলিম সারা বছর আল্লাহর আনুগত্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়, তাহলে এই মাস তার জন্য আরো কল্যাণ বৃদ্ধির একটি মাধ্যম হবে। আর যদি কোনো মুসলিম সারা বছর আল্লাহর আনুগত্যে গাফিলতি করে থাকে, তাহলে সে এই মাসে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করবে, এরপর তার জীবন নতুন করে শুরু করবে – এবং এই মাসের পরেও আল্লাহর আনুগত্যের পথে অবিচল থাকবে। আর যদি সে এমন ব্যক্তি হয় যার জন্য তার বড় বড় পাপ বা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ানো গুনাহের কারণে জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত হয়ে গিয়েছিল, তাহলে তার আল্লাহর কাছে তাওবাহ করা আবশ্যক, ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। নবি () থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে: “রমাদানের প্রথম অংশ হলো রাহমাহ (দয়া), এর মধ্যবর্তী অংশ হলো মাগফিরাত (ক্ষমা), আর শেষাংশ হলো নাজাত (জাহান্নাম থেকে মুক্তি)।” [১]

এই পুরো মাসই আল্লাহর পক্ষ থেকে রাহমাহ (দয়া), বান্দাদের জন্য মাগফিরাত (ক্ষমা) আর গুনাহগারদের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি (নাজাত)। একজন মুসলিম যেন এই মাসে নিজেকে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত না করে: হয় সে পূর্বের মাসের তুলনায় এই মাসে নেক আমল বাড়িয়ে দিবে যেমনটা সালাফদের অভ্যাস ছিল, অথবা নিজের গাফিলতির জন্য তাওবাহ করবে এবং নেক আমল ও আনুগত্য দ্বারা সেই ত্রুটি পূর্ণ করবে; অথবা সে তার কবিরা গুনাহ ও জঘন্য সীমালঙ্ঘন থেকে তাওবাহ করবে, যা তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হওয়ার কারণ হয়, যেন আল্লাহ তাকে শাস্তি থেকে মুক্তি দেন। সুতরাং, এটি এক মহান মাস, দয়া ও অনুগ্রহে পরিপূর্ণ একটি সময়—তাই আনুগত্যমূলক আমল ও তাকওয়ার মাধ্যমে এটির যথাযথ মূল্য ও মর্যাদা দিন। আর আল্লাহ (জাল্লা ওয়া আলা) বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

ثُمَّ بَعَثْنَا مِن بَعْدِهِم مُّوسَىٰ بِآيَاتِنَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ وَمَلَئِهِ فَظَلَمُوا بِهَا ۖ فَانظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ

أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ ۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۚ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ ۖ فَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ ۚ وَأَن تَصُومُوا خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ ۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۗ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

“হে মুমিনগণ ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পার। এগুলো গোনা কয়েক দিন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। আর যাদের জন্য সিয়াম কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদ্‌ইয়া- একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার জন্য কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণের যদি তোমরা জানতে। রামাদান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াহর জন্য এবং হিদায়াহর স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াহ দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” [২]

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন যে, তিনি আপনাকে এই বরকতময় মাসে পৌঁছানোর সুযোগ দিয়েছেন। অনেক নেককার মুসলমানের জন্য এই মাস একটি নিয়ামাহ, কল্যাণ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও তাদের মর্যাদার স্তর বৃদ্ধির মাধ্যম, কারণ তারা নিজেদেরকে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদাহয় নিয়োজিত রাখে।


আর কিছু মানুষ এমনও আছে যারা এই মাসে প্রবেশ করে গাফিলতির সাথে, পাপ ও মন্দ কাজের মাধ্যমে নিজেদের রুহের ওপর জুলুম করে—তারা আল্লাহর কাছে তাওবাহ করে না, এবং এই মাসের কল্যাণ ও বারাকাহর প্রতি কোনো গুরুত্ব দেয় না। তারা এই মাসটিকে অন্যান্য মাসের মতোই পার করে, এর বারাকাহ থেকে বঞ্চিত হয় এবং যেভাবে প্রবেশ করেছিল, কোনো ফায়দা লাভ না করে সেভাবেই বের হয়ে যায়।

أُولَٰئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ
“এরাই তারা, আল্লাহ্‌ যাদের অন্তর, কান ও চোখ মোহর করে দিয়েছেন। আর তারাই গাফিল।” [৩]

 

وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنسَاهُمْ أَنفُسَهُمْ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
“আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্নবিস্মৃত করেছেন। তারাই তো ফাসিক।” [৪]

তো, এমন ব্যক্তিরা এ মাসে উন্নীত হয় না, তারা এই মাসের গুরুত্ব ও মূল্যই বোঝে না এবং নিজেদেরই বঞ্চিত করে। আমরা আল্লাহর কাছে কল্যাণের দোয়া করি।


মুমিনরা রামাদানকে স্বাগত জানায়, পক্ষান্তরে গুনাহগারেরা দূরে চলে যায়

এরপর কিছু মানুষ আছে যারা এই মাসটিকে শুধু খাদ্য ও পানীয়, অতিরিক্ত ভোগ-বিলাস, রেস্টুরেন্টে ঘোরা এবং তাদের পেট ভরানোর সময় হিসেবে দেখে—তারা কেনাকাটা ও খাওয়া-দাওয়ায় মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে। তারা কি জানে না যে এটি রোজার মাস, প্রবৃত্তির অনুসরণের মাস নয়? এটি রোজা, কিয়ামুল লাইল ও ইবাদাহর মাস—তাই সে তার প্রয়োজন অনুযায়ী খাবে, যেন সে বিভিন্ন আনুগত্যমূলক আমল সম্পাদন করতে পারে।

আর কিছু লোক তো এর চেয়েও খারাপ: তারা এই মাসের রাত কাটায় গিবত, ফ্যান্টাসি মুভি দেখা, তর্ক-বিতর্ক, কার্ড খেলা, নিরর্থক কথাবার্তা, অনর্থক আলোচনা ও অপ্রয়োজনীয় কাজে মশগুল হয়ে। তারপর যখন ফজর আসে, তারা ঘুমিয়ে থাকে এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটায়! তারা সালাত আদায় করে না, আল্লাহকে স্মরণ করে না। তাদের কাছে এই মাস মানে হলো রাত জাগা এবং দিনভর ঘুমানো। তারা ফরজ সালাত নষ্ট করে এবং তাদের সময় অপচয় করে—এটাই তাদের কাছে রামাদান মাসের অর্থ, এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তো, তারা কোন উপকারটি পেল? বরং, তারা এই মাসে কেবল গুনাহ ও লোকসানই জমা করল। আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা ও কল্যাণের দোয়া করি।

তাই যে এই গাফিলতিতে আক্রান্ত, তার উচিত আল্লাহর কাছে তওবাহ করা, এবং সে যাতে তাওবাহর দিকে ধাবিত হয়—তার রুহ কেড়ে নেওয়ার আগেই যাতে একে সংশোধন করে। কেননা, যদি কেউ তার সম্পদ, সম্পত্তি, পরিবার বা সন্তান হারায়, তাহলে সে কষ্ট তুলনামূলকভাবে সহনীয়। কিন্তু কেউ যদি তার দ্বীন হারায়, তার রুহকে হারিয়ে ফেলে, তাহলে তা চূড়ান্ত ক্ষতি—এবং আমরা আল্লাহর কাছে এর থেকে আশ্রয় চাই।

فَاعْبُدُوا مَا شِئْتُم مِّن دُونِهِ ۗ قُلْ إِنَّ الْخَاسِرِينَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُمْ وَأَهْلِيهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ أَلَا ذَٰلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ
“অতএব, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইচ্ছে তার ইবাদত কর। বলুন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা কিয়ামতের দিন নিজেদের ও নিজেদের পরিজনবর্গের ক্ষতিসাধন করে। জেনে রাখ, এটাই সুস্পষ্ট ক্ষতি।” [৫]

তাই, আল্লাহকে ভয় করুন, হে আল্লাহর বান্দারা! এই মাসের মহত্বের প্রতি মনোযোগী হোন। তা কাজে লাগান যা আপনার উপকারে আসবে এবং আপনাকে আল্লাহর আরো কাছাকাছি নিয়ে যাবে। এই মাসকে আল্লাহর সামনে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যম বানান এবং এটাকে আপনার গুনাহর প্রায়শ্চিত্ত ও মোচনের কারণে পরিণত করুন। [৬]

সমাপ্ত।


ফুটনোট:
[১] ইবনু খুযাইমাহ কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিসের একাংশ, কিন্তু এর ইসনাদে ইবন জাদাআন রয়েছে, এবং সে দুর্বল।
[২] আল-বাকারাহ: ১৮৩-১৮৫
[৩] আন-নাহল: ১০৮
[৪] আল-হাশর: ১৯
[৫] আয-যুমার: ১৫
[৬] খুতুব আল-মিম্বারিয়্যাহ, ৫ম খণ্ড, ২৫৯-২৬২ পৃ. দেখুন– abukhadeejah.com
Next Post Previous Post
কোনো কমেন্ট নেই
কমেন্ট করুন
comment url